ইলেক্টিক্যালে ডিপ্লোমা পাস করে ফেনা এখন বেকার। একেবারে বেকার বলা যায় না।
ব্রাহ্মানবাড়িয়া সরকারী কলেজে বাংলায় অনার্স করছে। তার পরও তার অলসতার
অফুরন্ত সময়। সারা রাত জেগে থাকা আর দুপুর বারটা একটা পর্যন্ত ঘুমানো, এক
প্রকার রুটিন হয়ে গেছে। প্রায় বিকেলে আড্ডা হয় পাইক পাড়া আরাফাত ষ্টোর আর
নাভানা শো রোমে। তেমনি এক বিকালে সিগারেট হাতে বেশ আড্ডা জমে উঠে। জমে উঠা
আড্ডার মাঝ পথে যোগদেন এলাকার বড় ভাই মাহবুব। ফেনার হাত থেকে সিগারেটটা টান
দিয়ে নিয়ে বলেন- কি আজাইরা গুরন আর হাওন। কাম কাইজ করতা না? ফেনা মাহবুব
ভাই এর দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে থাকে। যেন অসহায় দিনহীন এক ছেলে। আচমকা বলে
উঠে করুম কাম দেন। মাহবুব ভাই একটু সিরিয়াস হয়ে- সত্যি করবা? একটা
মাস্টারির চাকরি আছে। হইলে লাইগগা যাও। ফেনাও সিরিয়াস হয়ে বলল কোন স্কুল,
কি বিষয় পড়াতে হবে। হুমায়ুন কবীর পৌর প্রথমিক বিদ্যালয় এ, আর কি পড়াইতে অইব
তা কইতে পারি না। তয় তুমি কইলে আমি কথা কইতে পারি। সিগারেটে সুখ টান দিতে
দিতে বলল মাহবুব ভাই।
তিন দিন পর মাহবুব ভাই ফেনাকে ফোন দিলেন, বললেন
ছোট ভাই তুমি তারাতারি তোমার কাগজ গুলান স্কুলে জমা দেও। এখন আর কতা কইতে পরতাম না, দোয়া দরখাস্ত বলে ফোনটা রেখে দিলেন।
উনিশে মে, বৃহস্পতিবার। একটা মিনি ইন্টারভিও দিয়ে বাইশে মে হিসাব রক্ষক ও
শরীরিক শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেল। ফেনার সকালের আরামের ঘুম হারাম হয়ে গেল।
দুই হাজার টাকার চাকুরির জন্য সকাল সারে সাতটা থেকে দুপুর বারটা পর্যন্ত
গাধার খাটনি। সাথে যোগ হ্ল সাত জন মহিলা শিক্ষিকার অসহনিয় সঙ্গ। যা হোক
ফেনা তার কাজ ঠিক মত পালন করার শতভাগ চেষ্টায় ব্যস্ত। নতুন করে ভাবতে লাগল
সে যা জানে তা ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে শতভাগ উজার করে দিবে।
স্কুলের নিয়ম কানুন তেমন না থাকায় কিছু নিয়ম জারী করা হ্ল, আর যা ছিল তার
প্রয়োগে আরও কঠোরতা আনল । স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ম কানুন মেনে চলার
জন্য চাপ সৃষ্টি করায় আভিবাবকরাও অনেক খুশি। দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে
গেল। স্কুলের চেহারাও অনেক বদলেছে । মজার এবং অদ্ভুত বিষয় হ্ল এমন কোন দিন
নাই যে ছাত্র-ছাত্রীরা ফেনার হাতে মার না খায়। বেদম পিটানোটা ফেনার একটা
স্টাইল। পিটানো বলাটা ভুল হবে, কঠিন শাসন বলায় ভাল। কেউ যদি নিয়ম না মানে,
বেয়াদবি করে, পড়া শিখেনি তবে ঐ ছাত্র বা ছাত্রীর কপালে দুঃখ লেখা হয়ে যায়।
কোন শিক্ষিকার অনুপস্থিতিতে যদি ক্লাস নিতে যায় তবে আজ সেরেছে। উত্তম-মধ্যম
তো চলেই সাথে যারা পড়া শিখেনি তাদের ছুটির পড় বাড়ি যাওয়া বন্ধ। পড়া শিখে
দিয়ে তার পর যেতে হবে। আন্য শিক্ষকের ক্ষেত্রে হ্লেও উপায় নেই। আটকে রেখে
পড়া আদায় করে তবে ছুটি। ফলে দেখা গেল কয়েক দিনের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের
পড়াশুনার মাত্রাও বেড়ে গেছে। একটা বিশেষ মজার ব্যাপার হ্ল ফেনা যখন মারত
তখন গল্প বলে বলে মারত। তেমনি একটা গল্প হ্লঃ একটা ছোট বাচ্চা ছেলে একদিন
পড়া না শিখে স্কুলে গেল। স্যার ঐ দিনই তাকে পড়া ধরলেন। সে পড়া পাড়েনি। ফলে
স্যার বেত দিয়ে আচ্ছা মত পাছায় মারলেন। সেই ছাত্র কোন দিন তার নিজের পাছা
দেখেনি। সে দিন বাসায় এসে মনে মনে বলতে লাগল- হারামজাদার স্যার কি মারাই না
মারছে। আয়নার সামনে গিয়ে প্যান্ট খুলে পাছাটা দেখল। দেখেতো অবাক। একি
কান্ড। মানুষ মারে তাই বলে কি এই ভাবে মারে!! মারতে মারতে একেবারে পাছাটা
দুইটুকরা করে ফেলছে!
ফেনা যেমন বাচ্চাদের শাসন করে তেমনি অনেক আদরও করে। ফলে অল্প দিনের মাঝে
সবাই তার ভক্ত হয়ে গেল। মাঝে মাঝে যখন ওরা ফেনাকে তাদের সাথে টিফিন খেতে
বলে তখন ফেনার মনটা গলে একেবারে পানি হয়ে যায়। ভাবে এত শাসন করার পরও তারা
কত ভালবাসে। একটা অদ্ভুত মায়ার জালে ফেনা আটকে যায়।
একদিন এক জন অভিবাবক স্কুলের নিয়ম নিয়ে ফেনা তথা সব শিক্ষক-শিক্ষিকার সাথে
খারাপ ব্যাবহার করে। ফেনার খুব মন খারাপ হয়। ফেনা ঠিক করে সে আর এই চাকুরী
করবেনা। সাথে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে ইন্টারভিও দিয়েছে। চাকুরী হওয়ার
সম্ভাবনাও একটা আছে।
ঐ দিন তৃতীয় শ্রেনীতে সাধারণ জ্ঞানের ক্লাস ফেনাকে দেওয়া হ্ল। মুটামুটি
সবাই পড়া শিখলেও হাতে গুনা কয়েক জন শিখেনি। আর যায় কোথায়। উত্তম- মধ্যম
চলল। তাদের মাঝে দুইটা মেয়ে ছিল। মারার সময় ফেনা বলল- তোমরা যদি এভাবে পড়া
না শিখে আস তবে আমি আর তোমাদের ক্লাস নিব না। আমি চাকুরী ছেরে দিয়ে চলে
যাব, তোমাদের স্কুলেই আর থাকব না। ক্লাস শেষ, ঘন্টা পড়ল। ফেনা বারান্দায়
এসে দাড়াঁল। স্কুল ছুটি। সব ছাত্র-ছাত্রী লাফা লাফি করে বের হচ্ছে। হঠাৎ
ফেনা দেখল যে কয়েক জনকে একটু আগে বেদম শাসন করতে মেরে এসেছে তারা বারান্দার
কোণায় দাড়িঁয়ে। কি ব্যাপার তোমরা এখনে কেন? বাসায় যাও। ফেনা বলল। তখনও
মাথা নিচু করে ঠায় দাড়িঁয়ে। কি হ্ল কথা বলনা কেন, বলতে বলতে তাদের দিকে
এগিয়ে যায় ফেনা। তখন মাথা তুলে ফেনার দিকে চেয়ে বলে স্যার আপনার সাথে একটু
কথা বলব। কি কথা, বলে ফেনা ওদের মাথায় হাত রাখে। মনটা খুব খারাপ, কন্ঠ ভারী
হয়ে গেছে ওদের। ভিজা কন্ঠে ফেনার দিকে চেয়ে বলে - " স্যার আপনি যায়েন না।"